চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী আরিফ চৌধুরী চান্দগাঁওয়ের বাসায় যাওয়ার জন্য সাধারণত আখতারুজ্জামান উড়ালসড়ক (ফ্লাইওভার) ব্যবহার করেন। সেদিন ছিল ১৩ জুলাই বেলা তিনটা। লালখানবাজার থেকে মোটরসাইকেলে করে বাসার দিকে রওনা হন তিনি। উড়ালসড়কের ২ নম্বর গেট অতিক্রম করার পর হঠাৎ গাড়ি থেকে পড়ে যান আরিফ চৌধুরী। তখনই অল্পবয়সী দুটি ছেলে সাহায্য চাওয়ার ভান করে তাঁর কাছে আসে। তিনি কিছু বুঝে ওঠার আগেই ছেলে দুটো ছুরি দেখিয়ে তাঁর মুঠোফোন, টাকাকড়ি কেড়ে নিয়ে দ্রুত মোটরসাইকেলে সটকে পড়ে।
কীভাবে মোটরসাইকেল থেকে পড়ে গেলেন জানতে চাইলে আরিফ চৌধুরী এই প্রতিবেদককে বলেন, রশিটি গলায় লেগে তিনি গাড়ি থেকে পড়ে যান। পড়ে যাওয়ার পর গলায় হাত দিয়ে দেখেন, অল্প অল্প রক্ত ঝরছে। নাইলনের চিকন রশিটি তাঁর গলায় বেঁধে আছে। দূর থেকে তিনি রশিটি দেখতে পাননি। তাঁর ধারণা, রশিটি আগে থেকে উড়ালসড়কের এক পাশে বেঁধে রাখা হয়েছিল। তিনি কাছাকাছি আসার পর আরেক পাশে বেঁধে টাঙিয়ে দেওয়া হয়।
ভুক্তভোগী ও পুলিশের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যারা ছিনতাইয়ে জড়িত, তাদের বেশির ভাগই মাদকাসক্ত এবং উঠতি বয়সের ছিনতাইকারী। প্রায় দুই মাস ধরে এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। ছবি তোলা কিংবা দল বেঁধে ঘোরার ভান করে এরা উড়ালসড়কে অবস্থান নেয়। যখন গাড়ি চলাচল কম থাকে, তখনই মোটরসাইকেল আরোহীদের নিশানা করে তারা। আশপাশে গাড়ি কম থাকলে আগে থেকে এক পাশে বেঁধে রাখা রশিটি দ্রুত আরেক পাশে বেঁধে দেয়।
ব্যবসায়ী আরিফ চৌধুরীর ঘটনার পরদিন ১৪ জুলাই একইভাবে উড়ালসড়কে ছিনতাইয়ের ঘটনার শিকার হন ব্যবসায়ী ইমরান চৌধুরী। এর আগের দিন বহদ্দারহাটের মো. আবিদ নামের এক যুবক। ঘটনাগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হলে কিছুটা সতর্ক হন নিয়মিত যাতায়াতকারী যাত্রীরা। সর্বশেষ ১৫ জুলাই মো. ফারুক নামের এক মোটরসাইকেল আরোহী উড়ালসড়কের মুরাদপুর এলাকায় সুতা টাঙানো দেখে থমকে দাঁড়ান। তখনই দেখেন দুই তরুণকে দ্রুত মোটরসাইকেল চালিয়ে চলে যেতে। পরে তিনি রশিগুলো সরিয়ে নেন। সবাইকে সতর্ক করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন। মো. ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, ঝামেলা এড়াতে তিনি মামলায় জড়াননি।
বিভিন্ন ফেসবুক গ্রুপ এবং এই প্রতিবেদকের হিসাবে, ফেব্রুয়ারি থেকে গত প্রায় ছয় মাসে চট্টগ্রাম নগরের চারটি উড়ালসড়কে রশি টানিয়ে ৫০টির বেশি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু এসব ঘটনায় থানায় মামলা হয়নি বললেই চলে। এ মাসে কেবল একটি মামলা হয় পাঁচলাইশ থানায়। ভুক্তভোগীদের ভাষ্য, মামলা করতে গেলে নানা ঝামেলা হয়। তার চেয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সচিত্র স্ট্যাটাস দিলেই কাজ হয়। এ জন্য অনেকেই গলা ও ঘাড় কেটে যাওয়ার ছবি দেন, যাতে অন্যরা সাবধান ও সচেতন হয়।
ফেব্রুয়ারির পর গত প্রায় ৬ মাসে ৫০টির মতো ছিনতাইয়ের ঘটনা
আতঙ্কে মোটরসাইকেল আরোহীরা
সূত্রমতে, ফেসবুকসহ নানা মাধ্যমে জানার পর পুলিশ ঘটনার শিকার ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। নগর গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার আলী হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘ফেসবুকে দেখে ঘটনার শিকার অনেকের সঙ্গে কথা বলেছি। জড়িতদের চিহ্নিত করার কাজ চলছে। পাশাপাশি সাদাপোশাকে গোয়েন্দা পুলিশের টিম উড়ালসড়কে রাখা হয়েছে। আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।’
তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তরফে আশ্বস্ত করা হলেও অনেকেই আস্থা পাচ্ছেন না। গোলাম হোসাইন নামের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের এক কর্মকর্তা জানান, উড়ালসড়কে সাম্প্রতিক সময়ে রশি দিয়ে ছিনতাইয়ের ঘটনা বেড়ে যাওয়ার তিনি উড়ালসড়ক ব্যবহার করেন না।
জয়নাল আবেদীন নামের এক ব্যক্তি জানান, জুন মাসের শেষের দিকে মোটরসাইকেল করে যাওয়ার সময় কদমতলী উড়ালসড়কে সুতায় আটকে পড়ে যান তিনি। এতে সামান্য আহত হন। এরপর তিনিও উড়ালসড়ক ব্যবহার করা কমিয়ে দিয়েছেন।
চট্টগ্রাম নগরে চারটি উড়ালসড়ক রয়েছে। যানজটমুক্ত হয়ে সহজে গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য বিশেষ করে মোটরসাইকেল আরোহীরা উড়ালসড়ক বেশি ব্যবহার করে থাকেন। ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা জানিয়েছেন, করোনা সংক্রমণ থেকে বাঁচতে মানুষ গণপরিবহন এড়িয়ে ব্যক্তিগত গাড়ি, মোটরসাইকেলের দিকে ঝুঁকছে বেশি।
আখতারুজ্জামান উড়ালসড়কের যে অংশটিতে বেশি ছিনতাই হয়, তা নগর পুলিশের উত্তর বিভাগের আওতাধীন। জানতে চাইলে নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (উত্তর) আশিকুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশি পাহারা জোরদার রয়েছে। এরপরও কেউ ঘটনার শিকার হলে যেন পুলিশকে জানান।
ছিনতাইয়ের ঘটনার শিকার হলেও ভুক্তভোগীরা মামলা বা পুলিশের শরণাপন্ন হচ্ছে না কেন, এমন প্রশ্নের জবাবে পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘মামলা না করার পেছনে পুলিশের প্রতি অনাস্থার বিষয় নেই। সচেতনতার অভাবই মূল কারণ।’ উড়ালসড়কে ছিনতাই প্রতিরোধে পুলিশের বিশেষ টিম কাজ করছে বলে জানালেন তিনি।